মংক্যথোয়াই মারমা:
মারমা সাহিত্যে সবচেয়ে বড় লোককাহিনি হচ্ছে বীর থামরাহ্’র কাহিনি। মারমা সংস্কৃতির বিলুপ্তপ্রায় সময়ে এ ধরণের হারিয়ে যাওয়া গল্পগুলো আমরা আবার ফিরিয়ে আনতে চাই। জীর্ণপ্রায় সাংস্কৃতিক উপাদানগুলো প্রাণ ফিরে পাক। এ কাহিনিটি খুব সংক্ষেপে বাংলায় তুলে ধরা হল:
সিংজুগু রাজার ছেলে ওয়াগাহ আরেক রাজা মুফির মেয়ে পাইংগুমেকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। তাতে রাজা মুফি সম্মতি না দেওয়ায় রাজপুত্র ওয়াগাহ মুফি রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু ওয়াগাহ অতিশয় ধার্মিক হওয়ার কারণে যুদ্ধের তীরগুলো সরাসরি সৈন্যদের দিকে না ছুঁড়ে আকাশের দিকে ছুঁড়লো। এতে তীরগুলো মুফি রাজার সৈন্যদের গায়ে না লাগায় তার বাবার ছোট ভার্য্যার পুত্র মাংখংকে যুদ্ধে সাহায্যের জন্য ডাকাহয়। মাংখং এমন যুদ্ধ করলেন যে শেষ পর্যন্ত মুফি রাজা তার কন্যাকে ওয়াগাহ’র হাতে তুলে দিতে রাজি হলেন।
কিন্তু এবারে রাজপুত্রের সাথে মুফি রাজার মেয়ের বিয়েতে বাধা দিল মাংখং। যেহেতু তিনি যুদ্ধ করেছেন বলেই মুফি রাজাকে পরাজিত করা গেছে; সেহেতু রাজার মেয়ে পাইংগুমের সাথে রাজপুত্র ওয়াগাহর নয় মাংখংকেই বিয়ে দিতে হবে। যায় হোক, ওয়াগাহ এবং মাংখং এর বাবার ইস্তফায় মাংখংকে বিয়ে দেওয়া হল রাজপুত্র ওয়াগাহর বোন ফুমের সঙ্গে (ওয়াগাহ এবং মাংখং এর বাবা সিংজুগু হলেও তাদের মা ভিন্ন হওয়ায় মাংখং এর সাথে রাজকন্যা ফুমের বিয়ে বৈধ ছিল এবং তখনকার সময় এ বিয়ের বৈধতা ছিল)। ওয়াগাহকে তার বাবা উপরাজ করে তংখংম্রো’তে বসবাসের জন্য ব্যবস্থা করে দিলেন। সেখানেই তাদের নতুন জীবনের শুরু। এদিকে রাজপুত্র ওয়াগাহর আগে থেকেই প্রিয় প্রিয় খেলা ছিল পাশা খেলা। ‘ছাংকুংতং’ নামের একটি জায়গায় একটানা তিন মাসের মতো তিনি পাশা খেলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন নিজ রাজ্য তংখংম্র ‘র কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে। এমন সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করলেন না আরেক রাজপুত্র মাংখং। তিনি অতর্কিতভাবে সৈন্য সামন্ত নিয়ে রাজপুত্র ওয়াগাহ’র রাজ্য তংখংম্রো দখল করে ফেললো। সেই সাথে তিনি রাজপুত্র ওয়াগাহ’র স্ত্রী পাইংগুংমেকে জোর করে বিয়ে করে ফেললেন।
এ খবরটা যখন ওয়াগাহর পেলেন, ততক্ষণে সব শেষ। রাজপুত্র ওয়াগাহ তার রাজ্য তংখংম্রো থেকে বিতাড়িত হয়ে দক্ষিণ পূর্ব দিকে চলে গেলেন। সেখানে আরেক নতুন রাজ্য যুদ্ধ করে জয়ী হলেন। নাম শ্যামদেশ বা থাইল্যান্ড। রাজা শাইং মাং বা শ্যামরাজের মেয়ে রাজকন্যা গুমারকে বিয়ে করলেন ওয়াগাহ। পরে তার শ্বশুর শাইংমাং এর ষড়যন্ত্রে তিনি সেই দেশ থেকেও বিতাড়িত হন। বিতারিত হওয়ার আগে রাজকন্যা গুমার সাথে প্রেখ্রাদং এ তিন বছর বসবাস করেছিলেন ওয়াগাহ। সে সময় তাদের একটি পুত্রসন্তানের জন্ম হয়; যার নাম রাখা হয়েছিল থামরাহ।
ওয়াগাহ’র শশুর শাইংমাং ছিলেন খুবই কৃপণ আর হিংসুটে। তাই তার বংশে কোনো পুত্র সন্তানের জন্ম হোক তা তিনি চাননি। তার ভয় ছিল, বংশে কোনো পুত্র সন্তানের জন্ম হলে যেকোনো সময় তার রাজত্ব হারাতে হতে পারে। তাই রাজা শাইংমাং তার বংশে কোনো পুত্র সন্তান হলে সাথে সাথে তাকে মেরে ফেলার আদেশ দিত। এ কারণে মারমারা এখনও কথায় কথায় উদাহরণ দিতে বলে, ‘এতো দেখছি একদম শাইংমাংএর মতো’। মারমা ভাষায় একটা কথাও আছে এরকম ‘শাইংমাংমা সাইংথি ম্রঃমা রি’ অর্থাৎ সাগরের জলের পরিমাণ কৃপণ ছিলেন এই রাজা শাইংমাং।
তাই ওয়াগাহ’র পুত্র থামরাহ’র জন্মের সময় তার স্ত্রী গুমা নিজের বাবাকে বলেছিলেন তাদের মেয়ে হয়েছে। এদিকে বেশ কয়েক বছর পর ওয়াগাহ ও গুমার পুত্র থামরাহ বড় হলে একদিন ‘ধঃ’ খেলা( মারমাদের একটি ঐতিহ্যবাহী খেলা) দেখতে তার দাদুর রাজ্যে চলে যান। সেখানে তিনি এই ঐতিহ্যবাহী ধঃ খেলায় সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন।
অবশেষে তার দাদু শ্যামদেশের রাজা শাইংমাং নাতীকে চিনতে পারেন। ইতোমধ্যে রাজপুত্র থামরাহ যৌবনে পদার্পন করেছেন। আর অন্যদিকে রাজা শাইংমাং এর এখন সে শক্তি নেই যে থামরাহকে মেরে ফেলার। এছাড়া রাজপুত্র থামরাহ’র পিতা ওয়াগাহকে তার শ্যালক মাংখং ‘পাগাইং অইং’ এর পানিতে চুবিয়ে মারেন; গলায় পাথর এবং কোমরে কলসী বেঁধে দিয়ে।
বাবার হত্যার প্রতিশোধ নিতে রাজপুত্র থামরাহ রওনা হন বাবার হারানো রাজ্য তংখংম্রো এর উদ্দেশ্যে। সেখানে পৌঁছানোর আগেই তার সাথে দেখা হয়ে যায় মামা মাংখং এর প্রথম স্ত্রী রাজা ফুমের কন্যা ছাং হ্রুইমা’র সাথে। রাণী ফুমে সম্পর্কে রাজপুত্র থামরাহ’র মামী হয়। তবে কিছুদিনের মধ্যে এ দুজনের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে, যদিও ছাং হ্রুইমা ওয়াগাহ’র চেয়ে বয়সে প্রায় দ্বিগুণ বড় ছিলেন। শেষ পর্যন্ত রাজপুত্র থামরাহ রাজ্য তংখং ম্রো আক্রমণ করেন এবং মামা মাংখংকে যুদ্ধে পরাজিত করে সেই শহরেই তার রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন। যুদ্ধে মামা মাংখং এর মৃত্যু হয়।
প্রতিক্ষণ/এডি/শাআ